বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০২০ সালের ২৬ মার্চ ২৫০টি বিছানার চাদর কেনে। এই চাদরগুলো কেনা হয় চার লাখ ৯৯ হাজার ৫০০ টাকায়। প্রতিটি চাদরের দাম পড়ে এক হাজার ৯৯৮ টাকা। এই চাদরগুলোই তিনবার কেনা হয়েছে দেখিয়ে মেসার্স মিয়া হায়দার আলী নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে তিনবার বিল দেওয়া হয়।এতে প্রতিটি চাদরের দাম পড়েছে পাঁচ হাজার ৯৯৪ টাকা।
একই ঘটনা ঘটেছে ডিজিটাল সাইনবোর্ড কেনার ক্ষেত্রেও। এখানে মেসার্স এ আবিদ ট্রেডার্সের কাছ থেকে তিনটি ডিজিটাল সাইনবোর্ড কেনা হয় চার লাখ ৯৯ হাজার ৪৪৬ টাকায়। প্রতিটির দাম পড়ে এক লাখ ৬৬ হাজার ৪৮২ টাকা। ২০২০ সালের ৯ জুন কেনা এসব ডিজিটাল সাইনবোর্ডেরও বিল দেওয়া হয় তিনবার। ফলে একেকটি সাইনবোর্ডের দাম দাঁড়ায় চার লাখ ৯৯ হাজার ৪৪৬ টাকা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের কেনাকাটায় এমন দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে পরিবহন নিরীক্ষা অধিদপ্তরের করা প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ রেলওয়ের ভাণ্ডার বিভাগের ক্রয়, মজুদ ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ২০২০-২০২১ অর্থবছরের হিসাবের ওপর এই নিরীক্ষা করা হয়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, মোট ৫০ ক্যাটাগরিতে ১১৭ কোটি ৩৯ লাখ ৫৮ হাজার ৮৩৫ টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
এসব আপত্তির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বেশির ভাগের জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেনি নিরীক্ষাদল। অসন্তুষ্টির বিষয়টি প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাজারের চেয়ে বেশি দামে ১১ ক্যাটাগরির মালপত্র কিনেছে রেলওয়ে। এসব পণ্য কিনতে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ৫৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭৮ টাকা। এর মধ্যে রাবার কাপলিং কেনা হয় ১০টি, যার প্রতিটির বাজারমূল্য পাঁচ হাজার ৩৫৬ টাকা হলেও কেনা হয় ৩৩ হাজার ৯৫০ টাকায়। মেসার্স ভুলু কেমিক্যালের কাছ থেকে মালগুলো কেনা হয়। ১২০টি এসএস চেকার্ড প্লেট কিনেছে রেল, যার প্রতিটির বাজারমূল্য ১১ হাজার ৬৬০ টাকা; কিন্তু এগুলো কেনা হয়েছে ২০ হাজার ৬৬০ টাকা করে। এই প্লেটগুলো মেসার্স ভূইয়া এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে কেনা হয়। একই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১২০টি এসএস শিট শাইনিংও কেনা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিটির বাজারমূল্য ১১ হাজার ৮৮ টাকা হলেও দাম দেওয়া হয় ১৯ হাজার ১০০ টাকা করে।
গত অর্থবছরেও করোনা স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি অবস্থানে ছিল সরকার। তাই ওই সময়ে করোনা স্বাস্থ্যবিধির সঙ্গে জড়িত জিনিসপত্রও রেল নিয়মিত কিনেছে। এই পণ্যগুলো মেসার্স কাজী এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে কেনা হয়।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ৫৬ টাকার ১০০টি কেএন-৯৫ মাস্ক ৩৯৫ টাকা করে কেনা হয়েছে। ২৮০ টাকার এক বক্স সার্জিক্যাল মাস্ক কেনা হয় দুই হাজার ১৮৫ টাকায়। এক হাজার ৪০০ টাকার এক বক্স হ্যান্ড গ্লাভস কেনা হয় দুই হাজার ৬০০ টাকায়। হাত ধোয়ার জন্য ১২৬ টাকার জীবাণুনাশক কেনা হয় ৩৬০ টাকায়। ৩০৮ টাকার এক লিটার জীবাণুনাশক কেনা হয় ৪৪৫ টাকায়। এসব পণ্য কিনতেই এক ঠিকাদারকে চার লাখ ৭৬ হাজার ৪২২ টাকা বেশি দেওয়া হয়।
এ ছাড়া ১০ ফুট উচ্চতার দুটি এমএস র্যাক এবং ৪০টি ওয়াকি টকি কেনা হয়। এই দুই পণ্য কিনতে বাজারের চেয়ে অতিরিক্ত ১৭ লাখ এক হাজার ১৬ টাকা বেশি দাম দেওয়া হয়। ৮৬ হাজার ২১২ টাকার একটি র্যাক কেনা হয়েছে দুই লাখ ৪৯ হাজার ৭৪০ টাকায়। আর ১৭ হাজার ৫০১ টাকার একটি ওয়াকি টকি কেনা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫০ টাকায়।
রেলওয়ের ‘ভাণ্ডার বিভাগের ক্রয়, মজুদ ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা’ শাখার অধীনে এসব কেনাকাটা করা হয়। এই বিভাগ রেলের রোলিং স্টকের (আরএস) অধীনে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। তাঁর দপ্তরে গেলেও তিনি সাক্ষাৎ দেননি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব মাল ভালো দেয়নি সেগুলো পরিবর্তন করে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা পরিবর্তন না করায় রেলের ১২ কোটি ৫৯ লাখ ৮৯ হাজার ৮৬৩ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ১১ ভাগে কেনা বেশির ভাগ মালই হচ্ছে রেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। সব যন্ত্রই কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কেনা হয়। এসব মাল কেনার ক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।
নিরীক্ষাদলের আপত্তির জবাবে রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চারটি মাল পরিবর্তনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এগুলো প্রক্রিয়াধীন। আর কিছু মাল সঠিকভাবেই বুঝে পাওয়া গেছে। ফলে কোনো আর্থিক ক্ষতি হয়নি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, রেলের ভাণ্ডারে বিভিন্ন সামগ্রীর জন্য দুই কোটি ২৮ লাখ ৮৬ হাজার ১৯৮ টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু এসব খরচের কোনো ধরনের বিল বা ভাউচার পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে নিরীক্ষাদল বলছে, একাধিকবার এসব খরচের ভাউচার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে চাইলেও তাঁরা তা দেখাতে পারেননি।
এসব দুর্নীতির বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কথা বলতে চাননি। তাঁর দপ্তরে গেলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গাড়ি মেরামত বাবদ অতিরিক্ত তিন লাখ ২৫ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। ভাণ্ডারে রাজস্ব স্ট্যাম্প কেনার আগেই ২১ লাখ এক হাজার ৯৮১ টাকার চুক্তি করে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। সঠিক কোড ব্যবহার না করে ১০ লাখ তিন হাজার ৯২০ টাকা খরচ করা হয়েছে।
পরিবহন নিরীক্ষা অধিদপ্তরের করা এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বেশির ভাগ আপত্তি নিয়ে জবাব দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে সেসব জবাবে নিরীক্ষা প্রতিবেদক সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জবাবগুলো ‘আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়’ বলে মন্তব্য করেছে নিরীক্ষাদল।
এদিকে রেলওয়ের বাণিজ্যিক কার্যালয়ে কেনা মালপত্রে ঘাটতি পাওয়া গেছে। কাগজে থাকলেও বাস্তবে মজুদ নেই প্রায় কোটি টাকার মালপত্র। মালপত্রের কাল্পনিক ব্যবহার দেখানো হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৬ লাখ টাকার। মালপত্র কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান (এনওএ) করার দীর্ঘদিন পর অনিয়মিতভাবে দুই কোটি ২২ লাখ ৬৮ হাজার ৪১৯ টাকার চুক্তি করা হয়েছে, যা আইনে সরাসরি অবৈধ। শুধু ঠিকাদারকে সুবিধা দিয়েই এনওএর নিয়ম মানা হয়নি। আবার কারিগরি নির্দেশনা না মেনেই দুই কোটি ৯২ লাখ ৩৮ হাজার ৭৬৪ টাকার মালপত্র কেনা হয়েছে।
কাগজে থাকলেও বাস্তবে মালপত্র মজুদ না থাকা প্রসঙ্গে আপত্তির জবাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘নিরীক্ষা আপত্তির সময় ওই মালপত্র পাওয়া যায়নি। তবে পরে মালপত্র ডিপোতে পাওয়া গেছে। ’ কেনা মালপত্রে ঘাটতির বিষয়ে সৈয়দপুরে রেলের কারখানায় বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক কোনো জবাব দেননি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অডিট আপত্তিগুলো বিশ্লেষণ করলেই এর পেছনের দুর্নীতিগুলো উঠে আসে। আপত্তিগুলো যখন এ ধরনের কেনাকাটা নিয়ে ওঠে, রেল মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা। ’ তিনি বলেন, ‘সব অডিট আপত্তি সঠিক না-ও হতে পারে। তবু অডিটের আপত্তিগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। ’
সুত্র কালের কন্ঠ
Leave a Reply