বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে চলতি অর্থবছরজুড়েই দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেশ চাপে থাকবে। চলতি ব্যয়সহ করোনার সময়ে স্থগিত আমদানি দেনা পরিশোধ করতে হবে এ অর্থবছরে।
একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণের চলমান কিস্তির পাশাপাশি স্থগিত কিস্তিও পরিশোধের চাপ বাড়বে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রিজার্ভের ওপর।
তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে পারে। এছাড়া আমদানি ব্যয়ও কিছুটা কমবে। বৈদেশিক মুদ্রার সার্বিক ঘাটতিও কমবে। এতে অর্থবছর শেষদিকে রিজার্ভ সামান্য বাড়তে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে রিজার্ভ বেড়ে ৪৮০০ কোটি ডলারে উঠেছিল। ওই সময়ে প্রতি মাসে আমদানি ব্যয় হতো ৫৫০ কোটি ডলারের মতো।
এ হিসাবে ওই রিজার্ভ ছিল প্রায় ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমান। গত অর্থবছরে রিজার্ভ ৫২০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।
গত অর্থবছর শেষে রিজার্ভ কমে ৪২০০ কোটি ডলারে নেমে আসে। বর্তমানে প্রতিমাসে আমদানি ব্যয় হচ্ছে ৭৫০ কোটি ডলারের বেশি।
উল্লিখিত মজুত দিয়ে (৪২০০ কোটি ডলার) সাড়ে ৪ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমান। চলতি অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বাড়িয়ে ৪৩০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরুতে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা পরিশোধ করার পর রিজার্ভ কমে ৪ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমে এসেছে। যা এখন আর ৪ হাজার ডলারের ওপরে উঠছে না।
উলটো প্রতিদিনই আমদানি ব্যয় মেটাতে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার রিজার্ভ কমে ৩ হাজার ৯৬৯ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে চলতি মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। যে কারণে এ মাস শেষে রিজার্ভ আবার ৪ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক নিরাপদ মান অনুযায়ী স্বাভাবিক সময়ে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়।
যদি খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয় তাহলে থাকতে হবে কমপক্ষে ৫ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান। বিশ্বব্যাপী অপরিহার্য পণ্যের বাজারে অস্থিরতা থাকলে কমপক্ষে ৭ মাসের সমান আমদানি ব্যয়ের রিজার্ভ থাকতে হয়।
বাংলাদেশ বর্তমানে ব্যাপক পরিমাণে খাদ্য আমদানি করে। একই সঙ্গে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে বিশ্ব পণ্য বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ে বড় ঘাটতি বিরাজ করছে। যা প্রতি মাসেই বাড়ছে। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও এখন সাত মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান থাকা উচিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
আমদানি ব্যয় নির্ভর করে পণ্যের আমদানির পরিমাণও আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম হু-হু করে বাড়ায় ২০২০ সালে প্রতি মাসে গড়ে আমদানি ব্যয় হতো ৩৫০ কোটি ডলার।
২০২১ সালে তা বেড়ে ৪৫০ থেকে ৫০০ কোটি ডলার হয়েছে। ২০২২ সালে তা আরও বেড়ে ৭৫০ কোটি থেকে ৭৯০ কোটি ডলারে উঠেছে।
এতে তিন মাসের বা ৭ মাসের আমদানি ব্যয়ের রিজার্ভ রাখার পরিমাণও বেড়েছে। বর্তমানে আমদানি ব্যয়ের ধারায় গড়ে ৭ মাসের জন্য ৫ হাজার কোটি ডলারের ওপরে রিজার্ভ থাকা উচিত।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে রিজার্ভ থেকে প্রায় প্রতিদিনই ৭ থেকে ১০ কোটি ডলার করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।
এরপরও বাজারে ডলার সংকট প্রকট। তার মানে হচ্ছে আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়েই এখন রিজার্ভ ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো নিয়মিত এলসি খুলতেও পারছে না। এ অবস্থায় রেমিট্যান্স বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
রপ্তানি আয় বাড়ানো এখন চ্যালেঞ্জিং। কেননা রপ্তানির বড় বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা এখন মন্দায় আক্রান্ত। ফলে ওইসব দেশে রপ্তানি কমে যাবে। এদিকে আমদানি বেড়েই যাচ্ছে। এটি কমানো কঠিন। বেশি কমানো হলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যমান সংকট মোকাবিলায় মুদ্রা পাচার ও রেমিট্যান্সে হুন্ডি বন্ধ করাটা জরুরি। এছাড়া বৈদেশিক সংস্থাগুলো থেকে কম সুদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়া যেতে পারে। স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়া বন্ধ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি ঋণের কারণে সামনে আরও চাপ বাড়বে রিজার্ভে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৩৪ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে ১৯ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির এই রেকর্ড বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বড় সহায়তা করেছে। চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে বলে আভাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেননা বাংলাদেশে প্রধান ক্রেতা ইউরোপ ও আমেরিকা। দুটি অঞ্চলই এখন অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত। মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৪০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারও কমছে। এ কারণে রপ্তানি কমতে পারে।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি সাড়ে ১৪ শতাংশে সীমিত থাকার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু বছর শেষে তা বেড়ে প্রায় ৪৮ শতাংশ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণেই এমনটা হয়েছে। কেননা করোনার সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সীমিত থাকায় পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন কম হয়েছে।
করোনার প্রকোপ কমার পর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন বাড়ছিল তখন পণ্যের চাহিদাও বেড়ে যায়। বিপরীতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ছিল খুবই কম। যে কারণে পণ্যের দা বেড়েছে হু-হু করে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যায়। এ কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে লক্ষ্যমাত্রার আড়াই গুণ বেশি। চলতি অর্থবছরে আমদানির প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ১২ শতাংশ।
কিন্তু অনেকেই মনে করেন আমদানি ব্যয় এর চেয়ে বেশি হবে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম কমবে না। গত শুক্রবার রাশিয়া ইউক্রেনের মধ্যে খাদ্যসশ্য রপ্তানির বিষয়ে একটি চুক্তি হয়েছে।
এ চুক্তির ফলে গমের দাম কমতে শুরু করেছে। কিন্তু চালের দাম কমছে না। কারণ রাশিয়া ও ইউক্রেন চাল রপ্তানি করে খুবই কম। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বাংলাদেশে ওই চুক্তির তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে বিষয়টি ইতিবাচক।
গত অর্থবছরে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২০ শতাংশ। কিন্তু ওই লক্ষ্যমাত্রা তো অর্জিত হয়নি। উলটো কমেছে ১৫ শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, হুন্ডির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া, প্রণোদনা বাড়ানো, বিনিময় হারে বাড়তি দাম পাওয়া ও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো সহজ করায় এ খাতে প্রবাহ বাড়বে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে চলতি হিসাবে ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫৭ কোটি ডলার। কিন্তু অর্থবছর শেষে ঘাটতি হয়েছে ১৮০০ কোটি ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫৪৩ কোটি ডলার বেশি।
মূলত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি বাড়ায় এ খাতে ঘাটতি বেশি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে এ ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৬৫৫ কোটি ডলার।
যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২৪৫ কোটি ডলার কম। এর মানে হচ্ছে, চলতি অর্থবছরেও আমদানি রপ্তানির ব্যবধান বাড়বে। অর্থাৎ রপ্তানি কমবে। বিপরীতে আমদানি বাড়বে।
গত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬০৭ কোটি ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ২৭৫৭ কোটি ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি।
চলতি অর্থবছরে এ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৬০৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরেও রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয়ের মধ্যকার ব্যবধান বেশি থাকবে।
অব্যাহতভাবে চলতি হিসাবে ঘাটতি ও বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়া ভালো লক্ষণ নয় বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করেন, এতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমতেই থাকবে।
বিপরীতে ব্যয় বাড়তেই থাকে। এতে রিজার্ভের ওপর চাপও বাড়বে। এ ধারা চলতে থাকলে তা এক সময়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এজন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনার বিষয়ে এখনই সতর্ক হতে হবে।
প্রতিবেদনে আশার কথা হিসাবে উল্লেখ করা হয়, বৈদেশিক মুদ্রার সার্বিক আয় ও ব্যয়ের যে ঘাটতি এখন আছে, তা চলতি অর্থবছর শেষে কমে আসবে।
গত অর্থবছরে এ খাতে ৫১০ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত থাকার প্রাক্কলন করা হয়েছিল। কিন্তু বছর শেষে উদ্বৃত্ত তো থাকেনইনি। উলটো ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরে এ ঘাটতি কমে ১৫ কোটি ডলারে নেমে আসতে পারে।
সুত্র যুগান্তর
Leave a Reply