কোরবান আলী তালুকদার,ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি:
এ যেন সূর্যমুখী ফুলের রাজ্য। যতদূর চোখ যায়, ততদূর হলুদ রঙের ঝলকানি দেখা যায়। বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সবুজের মাঝে হলুদের সমাহার। সূর্যমুখী যেন সূর্যের দিকেই মুখ করে থাকে। সূর্যমুখী ফুল শুধু দেখতে রূপময় নয়, গুণেও অনন্য। টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলার গাড়াবাড়ি গ্রামের কৃষক মোশফিকুর রহমান চাষ করেছেন এ সূর্যমুখী। তাছাড়া প্রনোদনা, প্রদর্শনী ও উদ্ভুদ্ধকরনের মাধ্যমে এ উপজেলায় ১০ হেক্টর জমিতে এটি চাষ হয়েছে। উপজেলা থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সূর্যমুখীর এ বিশাল মাঠ।
বর্তমানে প্রতিদিন সূর্যমুখী ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেক দর্শনার্থী ভিড় করছেন এখানে। বসন্ত হাওয়া বইছে চারপাশে। সূর্যমুখী ফুল সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। সকাল বেলা পূর্বদিকে তাকিয়ে থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে সূর্যের সাথে ঘুরতে থাকে। একদিকে সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে যাওয়ার দৃশ্য, অন্যদিকে সূর্যমুখী ফুল তাকিয়ে থাকার দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম। মৌমাছিরা শেষ বিকেলে মধু সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সূর্যমুখী ফুল থেকে। তাছাড়া প্রতিদিন দেখা যায় প্রজাপতির মেলা। প্রাকৃতিক এ অপরূপ সৌন্দর্য যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। শিশু মন নেচে উঠেছে সেই হাসির দোলায়। কিন্তু রহস্যটা অনেক জটিল, যখন দেখলাম সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে সেই ফুল সূর্যের দিকেই মুখ করে থাকে। এই জন্যই নাম তার সূর্যমুখী। এখানে আসা দর্শনার্থীরা নির্মল বাতাস ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করেন। আগত দর্শনার্থীর এক দল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত, আরেক দল নিজেকে ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যস্ত।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সূর্যমুখী চাষাবাদ দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাজারে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন সূর্যমুখী ফুলের তেল কিনতে পাওয়া যায়। যদিও সূর্যমুখী ফুলের তেল বনস্পতি তেল নামে পরিচিত। ফুল থেকে তেল উৎপাদনের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে মধুও উৎপাদিত হয়।
সূর্যমুখী দেখতে রূপময় নয় গুণেও অনন্য। সূর্যমুখীর বীজের তেল স্বাস্থ্যের জন্য অসাধারণ। অন্যান্য তেলবীজে যেসব ক্ষতিকারক উপাদান (বিশেষ করে কোলেস্টেরল) থাকে সূর্যমুখীতে তা নেই। বরং আরও উপকারী উপাদান ও পুষ্টিগুণ বিদ্যমান। ঢাকাসহ দেশের মেট্রো সিটিগুলোর চেইন মার্কেটে ও সাধারণ মুদিদোকানে এমনকি সারা দেশের শহর–গ্রামের বাজারের প্রসিদ্ধ কিছু কিছু মুদিদোকানগুলোতে বোতলজাত সূর্যমুখীর তেল দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানির নিজস্ব উৎপাদিত ও বিদেশ থেকে আমদানি করা। দাম অনেক, তাই সাধারণের খাদ্যতালিকায় সূর্যমুখী তেলের প্রচলন নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য সূর্যমুখীর তেলের বিকল্প নেই। ভারতে এই তেল খুবই জনপ্রিয় ও প্রচলন আছে চোখে লাগার মতো। অন্য তেলের চেয়ে যদিও একটু দাম বেশি, তা সহনশীল ভারতের বাজারে। তাই ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে অঞ্চলভেদে সূর্যমুখী তেলের ব্যবহার লক্ষণীয়। উৎপাদনও ভারতে সূর্যমুখীর মন্দ নয়। সব কটি তেলবীজের তালিকায় সূর্যমুখীও ভারতীয় উৎপাদিত তেলবীজের অন্তর্ভুক্ত ও প্রচলিত মোটামুটি সহজলভ্য তেলবীজ, যা আমাদের দেশে সূর্যমুখী তেল সাধারণের সঙ্গে সাধারণ পরিচয় ঘটাতে এখনো অসফল। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জল, মাটি সূর্যমুখী চাষের অনুকূলে। বাংলাদেশে সূর্যমুখীর সম্ভাবনা উজ্জ্বল। আমরা বিদেশ থেকে রিফাইন্ড সয়াবিন তেল আমদানি করি, তাতে আছে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান। অথচ আমরা যদি দেশীয়ভাবে সূর্যমুখীর বীজকে প্রাধান্য দিয়ে রিফাইন্ড না করেও শুধু ঘানিতে সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল সংগ্রহ করি, আমাদের এই ভোজ্যতেলও হতে পারে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও সুস্বাস্থ্যকর।
আন্তর্জাতিক পুষ্টিবিদদের দেওয়া অনলাইন তথ্যসূত্র থেকে নেওয়া তথ্যমতে, সূর্যমুখী তেলে আছে মানবদেহের জন্য উপকারী ওমেগা ৯ ও ওমেগা ৬ এবং আছে অলিক অ্যাসিড। সূর্যমুখীর তেলে আছে শতকরা ১০০ ভাগ উপকারী ফ্যাট। আরও আছে কার্বোহাইড্রেট প্রোটিন ও পানি। সূর্যমুখীর তেল সম্পূর্ণ ক্ষতিকারক কোলেস্টেরলমুক্ত। আছে ভিটামিন ‘ই’, ভিটামিন ‘কে’ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন, আছে মিনারেল। মুখের যত্নে দাঁতের জন্য উপকারী একমাত্র তেল। হৃদরোগী, ডায়াবেটিসের রোগী উচ্চ রক্তচাপের রোগী, কিডনি রোগীর জন্যও সূর্যমুখীর তেল নিরাপদ।
আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে আমদানি করা সয়াবিন ও দেশীয় সরিষা তেলের ওপর নির্ভরশীল।সয়াবিন তেলে রয়েছে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক অনেক উপাদান, যা আমাদের স্থানীয়ভাবে ঘানিতে ভাঙানো সরিষার তেলেও ছিল না। সরিষার তেলই ছিল বাঙালির তেলের চাহিদা পূরণের প্রধান তৈলবীজ। আরও ছিল তিল, তিসি ও বাদাম। এই তিনটি তৈলবীজের তেলেও ক্ষতিকারক উপাদান এতটা নেই, যতটা আমদানি করা সয়াবিন তেলে আছে। প্রযুক্তির উন্নত ভার্সন বাদ দিয়ে কখনো কখনো পেছনের প্রযুক্তিতে ফিরে যাওয়াও ভালো বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। সেই অর্থে সূর্যমুখীর তেল হতে পারে আমাদের জন্য আশীর্বাদ। সূর্যমুখী দেখতে যেমন হাসিখুশি, সূর্যমুখীর বীজের তেলও সুস্বাস্থ্যকর। পুষ্টিগুণে অন্য সব তেলবীজ থেকে শ্রেষ্ঠ।
বাংলাদেশের অসংখ্য চরাঞ্চল ও হাওরের জমিতেও সূর্যমুখী উৎপাদন করা যেতে পারে বাণিজ্যিকভাবে। বিভিন্ন প্রতিকূলতায় অনেক জমিতেই প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। এসব জমিতে কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে সূর্যমুখী উৎপাদনে আগ্রহী হতে পারেন কৃষকেরা। বাংলাদেশের কৃষিতে বিপ্লব এসে গেছে। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি বিভাগ, কৃষি গবেষণা বিভাগ এখন অনেক স্বয়ংসম্পূর্ণ, কৃষিতে ভর্তুকিও চোখে লাগার মতো। শুধু তাই নয় বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকার ৩ বছরের মধ্যে দেশীয় উৎপাদিত তেল ফসলের মাধ্যমে তেলের চাহিদা ৪০% পূরণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং অদূর ভবিষতে এ দেশ তেলে স্বয়ংসর্ম্পূণ হয়ে উঠবে ইনশাল্লাহ।
Leave a Reply