কোরবান আলী তালুকদার, ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের মাসুদ রানা (৪২)। আশ্রয়ণ প্রকল্পের নতুন একজন সদস্য হতে চলছেন। তার আগের ঠিকানা ছিল উপজেলার অলোয়া গ্রামে। ২০১১ সালে তিনি সিএনজি দুর্ঘটনার শিকার হন। দুর্ঘটনার দিন জীবিকার তাগিদে ময়মনসিংহ যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে শহরের চরপাড়া নামক স্থানে ট্রেন-ট্রাক সংঘর্ষে ট্রাকের ধাক্কায় সিএনজি নিয়ন্ত্রণ হারায়। এতে মাসুদের দুই পা ও ডান হাত বিকল হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে। মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় চলত সংসার। অন্যদিকে তার ভিটেমাটি না থাকায় ৪ সদস্যের পরিবার নিয়ে গাদাগাদি করে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন তিনি।
পঙ্গুত্ব বরণের ২ বছর পর কিছুটা সুস্থ হয়ে ধারদেনা করে ভাড়া নেওয়া বাড়িটির একপাশে ছোট একটি চায়ের দোকান শুরু করেন। একদিকে বাড়িভাড়া, আরেকদিকে পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খান মাসুদ। এভাবে খেয়ে-না খেয়ে চলে তার অভাবের সংসার। ২০২১ সালের দিকে জানতে পারেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী অসহায়, ভূমি ও গৃহহীনদের ঘর দিচ্ছেন। তা শুনে ছুটে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে। সেখান থেকে দিকনির্দেশনা মতে ঘরের জন্য আবেদন করেন তিনি।
মাসুদ বলেন, আবেদনের পর যাচাই-বাছাই শেষে উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স্যারের সহযোগিতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাকা নতুন ঘর পেয়েছি। যেন স্বপ্নের নতুন ঠিকানায় উঠেছি। একইসঙ্গে ২ শতাংশ জায়গা, বিদ্যুৎ ও যাতায়াতের রাস্তাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও পেয়েছি। ভাবতেই পারিনি মুহূর্তেই আমার পঙ্গুত্ব জীবন ও পরিবারের স্বপ্ন বদলে যাবে। এর ফলে সন্তানদের স্কুল-মাদ্রাসায় পাঠাতে পেরেছি। আমার এ স্বপ্নপূরণ করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ইউএনও এবং পিআইও স্যারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
গোবিন্দাসী ইউনিয়নের বাগবাড়ী গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের মমতা রানী শীল বলেন, আমার জায়গা-জমি ছিল না। রাস্তার পাশে অন্যের জমিতে ভূমিহীন অবস্থায় স্বামী-সন্তান নিয়ে ঝুপড়ি ঘর তুলে থাকতাম। স্বামী নাপিতের কাজ করে যা রোজগার করে তা দিয়ে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করতাম। এখন প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর পেয়েছি। আশ্রয় পেয়ে আমরা আনন্দিত। দিনশেষে আপন ঠিকানায় ফিরছি। ইউএনও স্যার আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। স্যারের কাছে দাবি, আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশে চুলকাটা দোকানের জন্য একটু জায়গা চাই।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভূঞাপুর পৌরসভার শিয়ালকোলস্থ ফায়ার সার্ভিসের পাশে চতুর্থ পর্যায়ে ১২টি নতুন ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানেও কয়েক সপ্তাহ ধরে উপকারভোগীরা বসবাস করছেন। নতুন এ স্বপ্নের ঠিকানা পেয়ে নিজ নিজ ঘর গোছাতে ও কাজ-কর্মে ব্যস্ত নববাসিন্দারা। মুহূর্তেই বদলেছে এসব দরিদ্র-অসহায় মানুষের জীবনমান। তারা এখন বসবাস করছে রঙিন টিন আর পাকা দেয়ালের আধপাকা বাড়িতে। এর মধ্যেই অল্প সময়ে কেউ করছেন হাঁস, মুরগি, ছাগল ও গরু পালন। সুযোগ পেলে মুদিখানা, সেলুন ও দর্জি দোকান করার আশা প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
আশ্রয়ণে আসা নতুন বাসিন্দারা স্থায়ী ঠিকানা পেয়ে তাদের চোখে মুখে হাজারো স্বপ্ন। সকাল হলেই সন্তানদের পাঠাচ্ছেন স্কুলে। দুশ্চিন্তা ছেড়ে নিশ্চিন্ত মনে কাজ করছেন। সরকারের উদ্যোগে উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তর থেকে নিচ্ছেন নানা ধরনের কর্মসংস্থানের প্রশিক্ষণ। অনেকের মাঝে একাডেমিক শিক্ষা না থাকলেও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রকল্পের বাসিন্দারা হয়ে উঠছেন আত্মনির্ভরশীল। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের নিয়মিত তদারকির ফলে এগিয়ে যাচ্ছেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের দরিদ্র ও আশ্রয়হীন বাসিন্দারা।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম জানান, মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে “আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার” এ স্লোগানকে সামনে রেখে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দফায় উপজেলায় মোট ২৪২টি ঘর নির্মাণ কাজ হাতে নেওয়া হয়। তার মধ্যে চতুর্থ দফায় ৭২টি ঘরের কাজ শুরু চলমান। ইতোমধ্যে ৩০টির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেগুলো আগামী ২২ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করবেন এবং উপকারভোগীদের মাঝে হস্তান্তর করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ বেলাল হোসেন জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি স্বপ্নের প্রকল্প এটি। এ প্রকল্পের আওতায় উপজেলায় এ পর্যন্ত ২১২টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। চতুর্থ পর্যায়ে ৪২টি ঘর নির্মাণ করা হয়। তার মধ্যে ৩০টি ঘর আগামী ২২ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করবেন। এই ঘরগুলো টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দারের নেতৃত্বে ও নির্দেশনায় আমাদের উপজেলা পর্যায়ে ঘর নিমার্ণ কমিটির সদস্য, নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাসহ সবাইকে নিয়ে কাজের গুণগত মানোন্নয়ন বজায় রেখে অত্যন্ত সুন্দরভাবে কাজগুলো সম্পন্ন করে যাচ্ছি।
তিনি আরো জানান, টাঙ্গাইল-২ (ভূঞাপুর-গোপালপুর) আসনের সংসদ সদস্য ছোট মনিরের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং উপজেলার সব জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত রেখে প্রকৃত ভূমি ও গৃহহীন যারা আছে তাদেরকে তালিকা করে তাদের মাঝে এ ঘরগুলো দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ পর্যায়ে ঘরগুলো উদ্বোধনের দিন ৩০ জন উপকারভোগীদের মাঝে অন্যান্য কাগজপত্র বুঝিয়ে দেওয়া হবে। ঘর পাওয়া মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা ঘরগুলো পেয়ে অনেক খুশি ও উচ্ছ্বাসিত। তারা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন থেকে এ ঘরগুলো আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করব।
Leave a Reply