১৯২০ সালে ফ্রান্সের কলোনি হিসেবে সিরিয়া শাসন করে। ফ্রান্স কলোনি থেকে মুক্তির পর ১৯৭o সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাফিজ আল আসাদ ক্ষমতায় আসেন। সেই সময় ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা ,অর্থনীতি ও আরব জাতীয়তা সংকটে জর্জরিত । ক্ষমতায় বসেই হাফেজ বাথপার্টিকে কেন্দ্র করে একদলীয় শাসন এবং সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার কাজে মনোযোগ দেন। যদিও সিরিয়ার ৮৭% সুন্নী মুসলিম ,(১০%হাফিজ ছিলেন আলাবী শিয়া আলাওজ সম্প্রদায়ের ) বাকি অন্যান্য। কলোনি থেকে মুক্তির পর ফ্রান্স অত্যন্ত সুচতুর ভাবে শিয়া সুন্নীর দ্বন্দ্ব এবং সংখ্যা গরিষ্ঠের উপর সংখ্যা লগিষ্টের শাসন ও শোষণ চাপিয়ে দেয়।
হাফিজ আল আসাদের শাসনের শুরু থেকে ই এই ১০% লোকের মধ্যে থেকে আর্মি ,পুলিশ ,প্রশাসন সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে নিয়োগ দেন। দেশের বাকি ৮৭% সুন্নী মুসলিম ছিলো চাকরি সহ দেশের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তিনি ক্ষমতায় বসার পর নিরাপদে শাসন কার্য পরিচালনা করার জন্য মুসলিম দেশ গুলোর সাথে সম্পর্কের পাশাপাশি ইসরায়েলের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদন করেন।যে নীতি অনুসরনের মাধ্যমে ছেলে বাশার আল আসাদ ও দেশ পরিচালনা করেন।
হাফিজ আল আসাদের শাসন আমল থেকে ই দেশের মানুষ ফুসে উঠছিল। যে কেউ কোন কথা বললেই তাকে কঠোর হস্তে দমন করা হতো। ১৯৮২ সালে একটি শহরে ই আন্দোলন দমাতে তার ছোট ভাই রিফাতের নেতৃত্বে মাত্র ২৬ দিনে ৩০/৪০ হাজার মানুষকে হত্যা করেন।এবং পরিষ্কার জানান দেন যে,তার বিরুদ্ধে কোন কিছু ই বরদাস্ত করা হবে না। তিনি মূলত তার শাসন আমল সেনা নির্ভর ,,সামরিক শাসনে রুপান্তরিত করেন। এবং সেনাবাহিনী ,পুলিশ ,প্রশাসন ইত্যাদি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সকল জায়গায় তার নিকট আত্মীয় ,পারিবারিক লোক বসিয়ে দেশ পরিচালনা করেন। জেল জুলুম,নির্যাতন ইত্যাদি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
এইভাবে দমন নিপীড়নের মাধ্যমে দীর্ঘ ৩১ বছর শাসন করে ,২০০০সালে তার মৃত্যু হয়।বাবার মৃত্যুর সময় বাশার আল আসাদের বয়স ছিল ৩৪ বছর। কিন্তু সিরিয়ার সংবিধানে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ন্যূনতম বয়স ছিল ৪০।ছেলেকে প্রেসিডেন্ট করার জন্য পার্লামেন্টে মাত্র ২২ মিনিটের আলোচনায় সংবিধান সংশোধন করে ৩৪ বছর করা হয়।এবং বাশার আল আসাদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা বলেছিলেন । কিন্তু তিনি তার কথা না রেখে বাবার পদাংক অনুসরণ করেন।তিনি দম্ভকরে প্রায়ই বলতেন ,আমি সিরিয়ান ,সিরিয়া আমাকে তৈরী করেছে। আমি সিরিয়ায় থাকবো , সিরিয়ার মাটিতে মরবো। এটাই আমার জীবনের শেষ কথা। একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন নিজের মৃত্যু বা জীবন নিয়ে ভাবে না ,তিনি তার জাহাজ রক্ষা নিয়ে ভাবেন।
সেই জাহাজ রক্ষার জন্য তিনি বেপরোয়া হয়ে স্বেচ্ছাচারী , অত্যাচারী, স্বৈরশাসক ,নিষ্টুর এক নায়ক এবং আধিপত্য বাদের দৃষ্টান্ত হিসেবে সিরিয়া শাসন করেন।বাশারের পতনের পর তার যে বিভৎস চিত্র সারা দুনিয়ায় বেরিয়ে আসে। খবরে প্রকাশ দামাস্কের কুখ্যাত সেদনায়া কারাগারে এক লক্ষ ছয়ত্রিশ হাজার মানুষ কে বন্দী করে রাখা হয়। বিপ্লবের পর সেখান থেকে হাজার হাজার মানুষ মুক্তি পায়। সেখানে মাটির নিছে চার তলা বিলডিংগের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ছিল টর্চার সেল । সেখানে আলো বাতাস নেই । খাবার বলতে কিছু ই দেওয়া হতো না। সেখানে পা উপর দিয়ে ,অথবা দুই হাত ঝুলিয়ে রেখে নির্যাতন করা হতো । সেখানে অসংখ্য লোককে টর্চার করে হত্যা করা হতো। অসংখ্য লাশ একসাথে করে পুড়িয়ে ছাই করা হতো। যার কোন প্রমান রাখা হতো না।
বিপ্লবের পর কারাগারের সারিসারি ওয়ার্ড থেকে বাচানোর জন্য হাজার হাজার মানুষের আর্থ চিৎকার আসে। যে সব মানুষ তার বাবা হাফিজ আল আসাদের সময় থেকে সেখানে বন্দী আছেন । বাশারের পতনের পর ক্যামিকেল অস্ত্র তৈরির কারখানা পাওয়া যায়। যা বিরোধী দমনের জন্য তিনি ব্যবহার করতেন। একজন সংবাদিক ,একনারীকে জিজ্ঞেস করলেন তার অবস্থা। তিনি বর্ননা করে তার শরীরের ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে বলেন ,আমি ১৮ বছরের কুমারী হিসেবে ধরে এনে বন্দী করা হয়,এখন আমার বয়স ৪২। এত বছরে বন্দী অবস্থায় কতজন সন্তান জন্ম দিয়েছি এবং কোন সন্তানের বাবা কে তা আমি নিজেই জানিনা। এই সন্তান গুলো এখন যুবক, পৃথিরীর আলো বাতাস , সমাজ ,, রাষ্ট্রের মুখ কখনো দেখেনি। বাশার শাসন আমলের এ রকম হাজারো অত্যাচার নির্যাতনের চিত্র বর্তমান বিশ্বে আলোচিত।
স্বৈরশাসকের অত্যাচার নির্যাতন করে চিরস্থায়ী ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না। উত্তর আফ্রিকার আরব দেশ তিউনিসিয়া। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে একজন ফল বিক্রেতা প্রেসিডেন্ট জয়নাল বিন আলী শাসকের বিরুদ্ধে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মাহুতির পথ বেছে নেন। এই ঘটনার পর তিউনিসিয়ায় ব্যাপক গন আন্দোলন হয়। সেই গনঅভ্যুত্থানের মুখে বিন আলী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। সেখান থেকেই আরব বসন্তের ঢেউ লাগে আরব দেশে। একে একে পতন ঘটতে থাকে স্বৈরশাসকদের। সেই আছড় পড়ে সিরিয়াতে। অভিনব পন্থায় প্রতিবাদ উঠে। সিরিয়ার বাশারের একমাত্র রাজনৈতিক দল বাথপার্টির বিরুদ্ধে কথা বলার সব পথ ছিল রুদ্ধ। তখন জর্দানের সীনান্তবর্তী দক্ষিণাঞ্চলের ছোট্ট শহর দারাহ। সেখানে রাস্তার পাশে দেয়ালে একটা গ্রাফিতি আকে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র মুয়াবিয়া সায়সানেহ ।
স্প্রে করে লেখা ছিল “ডাক্তার এবার তোমার পালা “।এই লেখা বাশারের গোয়েন্দাদের নজর কাড়ে। হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে ব্যাক্তিকে। না পেয়ে কয়েক ডজন শিক্ষার্থীদের ধরে নিয়ে ২৬ দিন অমানুষিক নির্যাতন করে। এই ঘটনায় রাস্তায় নেমে আসে ছাত্র জনতা। ২০১১ সালে ১৫ই মার্চ প্রথম বারে দাবা নলের মতো ছড়িয়ে পড়ে দুর্বার আন্দোলন। যার পরবর্তীতে শুরু হয়ে যায় বর্তমান শতকের ভয়াবহ গৃহ যুদ্ধ। মুয়াবিয়ার গ্রাফিতি বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে স্বারক হয়ে যায় সিরিয়ার জাতীয় বিদ্রোহের। বদলে দিয়েছে সারা সিরিয়ার ভাগ্য।
একটানা তের বছরের গৃহযুদ্ধে নিহত হয় প্রায় পাচ লক্ষাধিক মানুষ। ধংস হয়ে গেছে শহর ,বন্দর ,গ্রাম জনপদ। সিরিয়ার জনগণের বিপক্ষে দাড়ায় রাশিয়া , ইরান সহ কয়েকটি রাষ্ট্র। ভেঙে যায় সিরিয়ার বাহিনীর মনোবল। আজ যে মূহুর্তে রাশিয়া ব্যস্ত ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ,আর ইরান এবং হিজবুল্লার সাথে ইসরায়েল। ঠিক সময় মতো গত আট বছর ধরে প্রস্তুতি ও শক্তি সঞ্চয় করে ত্রান কর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন “৪২ বছর বয়ষ্ক আবু মোহাম্মদ আল জোলানি “।জোলানির আসল নাম হলো আহমদ আল হোসেইন আল শারা।এবং তার সংগঠন “হায়াত তাহরীর আল শাম “।এত দিন তিনি গোপনে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন। কিন্তু শেষ আঘাতের সময় তিনি প্রকাশ্যে চলে আসেন ।
২৭ নভেম্বর: শুরু হয় চুড়ান্ত আঘাতের সম্মুখ যুদ্ধ। উত্তরাঞ্চলীয় আলেপ্পো প্রদেশে সিরিয় সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে বিদ্রোহীরা। ২৮ নভেম্বর আলেপ্পো থেকে রাজধানী দামেষ্ক সংযোগ কারী রাস্তা কেটে ফেলে ,তাতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ২৯/৩০ নভেম্বর হায়াত তাহরীত আল শাম বাহিনী আলেপ্পো শহরে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ করে বিদ্যুৎ গতিতে সরকারি বাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙে শহর দখল করে। একদিনের মধ্যে আলেপ্পো সহ উত্তরাঞ্চলের ৮০ টির বেশি শহর ,গ্রাম দখল করে। ডিসেম্বরের ছয় তারিখ পর্যন্ত আসাদ সরকারের প্রতি নি:শর্ত সমর্থন অব্যাহত রাখে রাশিয়া ও ইরান। সুতরাং বিপ্লবীরা তীব্র আক্রমন অব্যাহত রাখে। ৬ ডিসেম্বর বিপ্লবের রাজধানী খ্যাত হোমস শহরের কাছে এসে পৌঁছে। সাত ডিসেম্বর হোমস দখলে নিয়ে যায়।
সর্বশেষ আট ডিসেম্বর বিপ্লবীরা দামাস্ক আক্রমণ করে তখন সরকারি বাহিনী ও অন্যান্য সেনা পিছু হাটে । আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেডিও , টিভি ,সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখল করে নেয়। বাশার আল আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন খবর বেরিয়ে আসে। বিরোধীরা রাজধানী দামেষ্ক দখল করে আসাদ সরকারের পতনের ঘোষণা দেন। দীর্ঘ ৫৪ বৎসরের দু:শাসনের যে জগদ্দল পাথর সিরিয়া বাসীর বুকের উপর চেপে বসেছিল তার অবসান হয়েছে। দেশের জনগন প্রানখুলে কথা বলতে শ্বাস নিতে পারছে। এবং বাপ বেটার ৫৪ বৎসরের দু:শাসনের ক্ষোভে সকল জায়গায় নির্মিত মুর্তি মানুষ সত:ফূর্ত উল্লাসের সাথে ভাংগে। এবং দেশের তাদের নামের সব কিছু ই ছোড়ে ফেলে দিয়েছে । স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদ তার ঘনিষ্ঠ মিত্র পুতিনের জিম্মায় স্বপরিবারে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে বাশার মুক্ত সিরিয়ায় বেনইয়ামীন নেতানিয়াহুর জায়েনিস্টরা দু / তিন ,দিনের ব্যবধানে স্বরনকালের বৃহৎ আক্রমণ চার শত আশি বার বিমান হামলা করে বিমানবন্দর , সেনানীবাস ,অস্ত্রগার সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধংস করে গোলান মালভূমি দখল করে নিয়েছে। এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সৌদি আরব ,ইরান ,কাতার নিন্দা জানিয়ে,এই ধরনের আচরনে অত্র এলাকার শান্তি বিনষ্টের হুশিয়ারি দেন।এদিকে মধ্যেপ্রাচ্যের এই গুরুত্বপূর্ণ দেশকে নিয়ে পুরানো শকুনদের লোলুপ দৃষ্টি ,কালো থাবার জন্য কূটচাল দিচ্ছে। অচিরেই বুঝা যাবে সিরিয়ার জনগণের ভাগ্যে কি আছে।
লেখক নিউইয়র্ক প্রবাসী কলামিস্ট,রাজনীতিবিদ ও সদস্য সচিব,সিরাজুল আলম খান সৃতি পরিষদ নিউইয়র্ক ।
Leave a Reply